রাজশাহীর ব্যাংকিং অঙ্গনে ফের আতঙ্কের নাম হয়ে ফিরে এসেছেন বিতর্কিত কর্মকর্তা ওয়াহিদা বেগম। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে পুরনো দমননীতি, বদলি-বাণিজ্য এবং দলীয়করণে মোড়ানো ক্ষমতার অপব্যবহার। এই ভয়ংকর প্রত্যাবর্তনকে অনেকেই বলছেন “ব্যাংকিং নয়, যেন ফ্যাসিস্ট শাসনের ছায়া-সরকার”।
২০২৫ সালের ৯ মার্চ, ওয়াহিদা বেগম রাকাবের এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি শুরু করেন অভ্যন্তরীণ রদবদলের নামে রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান। বদলি, পদোন্নতি ও দমন সবকিছুই শুরু হয় পুরনো সিন্ডিকেট কৌশলের ছায়ায়।
বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের অভ্যন্তরে ‘পছন্দের লোক বসানো, বিপক্ষদের নির্বাসনে পাঠানো এবং ঘুষের বিনিময়ে পদোন্নতি’ এই ত্রিমুখী কৌশল আবারও সক্রিয়।
২০২৫ সালের ১৯ মে প্রকাশিত এক বদলি আদেশে দেখা যায়, রাজশাহীর বিভিন্ন শাখা থেকে ২১ জন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আদেশে তা “প্রশাসনিক কারণে” বলা হয়, কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে আসে রাজনৈতিক পরিচয়ভিত্তিক দমন-পীড়নের দৃশ্যপট। বদলিকৃত স্বল্প বেতনের এই কর্মকর্তাদের অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন বিএনপি-ঘনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ বা অভিজ্ঞ ব্যাংকার, সিনিয়র পেশাজীবী। তাদের পাঠানো হয়েছে দূরবর্তী সীমান্ত ঘেষা এলাকায়, অব্যবস্থাপনায় ভরা বা দুর্বল শাখাগুলোতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন “এটি কেবল বদলি নয়, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা। আপনি নিরপেক্ষ থাকলে, আপনার ঠিকানা হবে নির্বাসন।” কারণ ঢাকা শাখায় এবং প্রধান কার্যালয়ে অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ গত ১৭ বছর ধরে স্বৈরাচারের প্রভাব খাটিয়ে সগৌরবে চাকরি করছেন। যারা জুলাই’২৪ বিপ্লবকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়েছিলেন, তাদেরকে অদ্যাবধি সে সকল পদে বহাল তবিয়তে রেখেছেন স্বৈরাচারের দোসর ওয়াহিদা বেগম। কারণ তিনি এবং তাঁর প্রশাসন স্বৈরাচার খুনি হাসিনার প্রেতাত্মা।
ওয়াহিদা বেগমের বিরুদ্ধে পূর্বের প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে ঘুষের বিনিময়ে বদলি ও পদোন্নতির গুরুতর অভিযোগ। দুদকে জমা পড়েছে একাধিক লিখিত অভিযোগ, যেখানে রয়েছে চেকের ফটোকপি, বিকাশ/নগদ লেনদেন রেকর্ড, এমনকি অডিও ক্লিপ, যা থেকে স্পষ্ট হয় ঘুষের বিনিময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক ভুক্তভোগী বলেন “আমার ফাইল আটকে রাখা হয়েছিল। পরে বলা হয় টাকা দিলে হবে। নির্দিষ্ট নম্বরে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাঠানোর পরই পদোন্নতির চিঠি আসে।”
বর্তমানে ওয়াহিদা বেগমের এই ‘ফ্যাসিস্ট শাসন’ সফল করতে পাশে রয়েছেন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ রূপালী ব্যাংক পিএলসি’র সাবেক কর্মকর্তা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা ও বর্তমানে রাকাবের মহাব্যবস্থাপক (GM)। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন ব্যাংকের DMD, একাধিক GM, যাঁরা রূপালী ব্যাংক পিএলসিতে স্বৈরাচারের আমলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে দুদকে জমা পড়া অভিযোগও এখন রাজনৈতিক প্রভাবে চাপা পড়ে রয়েছে। সূত্র জানায়, শেখ ফজলে নূর তাপসসহ তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহলের একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ওয়াহিদা বেগমকে রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
রূপালী ব্যাংক পিএলসি’র সাবেক কর্মকর্তা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা এবং বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মহাব্যবস্থাপক (GM) জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,
“আমি সবসময় দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে আমার কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি। একজন অধস্তন কর্মকর্তা হিসেবে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসরণ করি। ওয়াহিদা বেগম ম্যাডামের অধীনে কর্মরত অবস্থায় আমি শুধুমাত্র প্রাপ্ত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছি। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত নীতি ও বিধির বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত নই।”
ব্যাংকিং পেশাকে রাজনৈতিক ‘পণ্যে’ রূপান্তরঃ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধরনের দলীয় নিয়োগ ও পদোন্নতি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্বকে ধ্বংস করে না, রাষ্ট্রীয় সেবাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা চূড়ান্তভাবে বিপন্ন করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক দুদক কর্মকর্তা বলেন “যদি একজন কর্মকর্তা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে বারবার দুর্নীতির দায় এড়ান, তবে সেটা কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয় সমগ্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এক বিশাল আঘাত।”
নিচে একটি সংক্ষিপ্ত, পেশাদার এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্যারাগ্রাফ দেওয়া হলো যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে অভিযুক্ত ওয়াহিদা বেগম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ফোন রিসিভ করেননি, পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে—যা একটি সাংবাদিকতাগত দায়িত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে:
এই বিষয়ে ওয়াহিদা বেগমের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
রাজশাহীতে ছাত্র, ব্যাংক কর্মকর্তা ও পেশাজীবী ফোরামের উদ্যোগে ওয়াহিদা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই আন্দোলন শুরু হয়েছে। তাদের দাবি:
অবিলম্বে ওয়াহিদা বেগমের অপসারণ, দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত, ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।
তাদের ভাষায়: “ওয়াহিদা বেগম স্বৈরাচার খুনি হাসিনার দোসর এটি এখন আর শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, ব্যাংক কর্মকর্তাদের মুখে মুখে উচ্চারিত বাস্তবতা।”
রাজশাহী প্রতিনিধি: 











