শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল | ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
Dainik Bangladesh - dainikbd24@gmail.com - facebook.com/Bangladesh24Official

বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকায় নাম থাকার পরও ভাতা থেকে বঞ্চিত

প্রকাশিত হয়েছে- শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মীর ইমরান মাদারীপুর প্রতিনিধিঃ

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর পেরিয়েছে।
এই তো ২০২১ সাল জুড়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম তো একই সুতোয় গাঁথা।

আর তার ডাকে সাড়া দিয়ে তদকালিন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত অন্তত সাত কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য যারা আত্মসুখ, ঘর-সংসার, পরিবার-পরিজন, পরিত্যাগ করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা আমাদের পরম বন্ধু,আত্মীয়,কল্যাণমিত্র, হিতৈষী, পরম আপনজন ।

শুধু তাই নয় মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে যে ভাবে অংশ নিয়েছেন তারা সকলেই আমাদের দেশের দেশপ্রেমী বীর সন্তান ।

তাদের প্রতি দায় কখনো শেষ হবার নয় । রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণ সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চিরদিনের মতো দায়বদ্ধ।

যারা একাত্তর ধারণ করে পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠেছে ও নিজেদের ভেতরে এক ধরনের আত্মগ্লানি আর হাহাকার তৈরি হয়। যখন শুনি, দেখি যে কোনও মুক্তিযোদ্ধা চরম অবহেলা-অমর্যাদায়, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ।

স্বাধীনতা পরের ৫০ বছরেও কোন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের দপ্তরে দপ্তরে আকুতি-মিনতি জানাতে হয়, ধর্ণা দিতে হয়- তখন জাতির কাছে এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

যদি তার এই আকুতি-মিনতি আর আবেদনকে মূল্যায়ন করা হতো, সম্মান করা হতো- তাহলে হয়তো কিছুটা গ্লানিবোধ কমতো বাঙালি জাতির ।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোও কাটিয়ে দিয়ে এক বুক কষ্ট আর অভিমান নিয়ে চিরবিদায় নিচ্ছেন ।

তেমনি এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার মাদারীপুর জেলা সদরের ছিলারচর ইউনিয়নের চর লক্ষ্মীপুর গ্রামের বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লার পরিবার চরম অবহেলিত ।

বাংলাদেশে ৭১সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় তালিকায় তার নাম থাকা সত্ত্বেও তার পরিবার পরিজন সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্ছিত । ১৯৮০ সালে সর্বহারা পাটির হাতে নির্মম ভাবে খুন হন বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লা । এসময় স্ত্রী ও নাবালক এক পুত্র সন্তান রেখে যান । তারপর অনেক কষ্টের মাঝেই দিন কাটে এই পরিবারটির ।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকলেও বিন্দু পরিমান সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লার পরিবার ।

এলাকাবাসী ও ঐ অঞ্চলের একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে এবং বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমি স্বাধীনতার লক্ষে বীর- মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম মোল্লা প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান ভারতের হাকিমপুর ভাদিয়ালি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে।

সেখানে অল্প সময়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে। তিনি সামনের সারির একজন সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন বলে জানান তার সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারী একাধিক বীর- মুক্তিযোদ্ধারা ।

ছিলারচর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন চৌকদার বলেন, বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লা একজন বিচক্ষণ ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । আমি ও রুস্তম মোল্লা এক সাথে ট্রেনিং করেছি এবং ৮নং সেক্টরের অধীনে অনেক দিন যুদ্ধুও করেছি । বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম মোল্লার হাতে অনেক পাক বাহিনী নিহত হয়েছে ।

এক পর্যায় আমাকে অন্য ক্যাম্পে পাঠানো হলে তখন আমি আমার ব্যাডিংপত্র রুস্তম মোল্লার নিকট রেখে যাই । তার মাস খানেক পরে দেশ স্বাধীন হয় । এরপর যশোর ক্যান্টমেন্টে অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন রুস্তম মোল্লাসহ মাদারীপুরের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগন ।

তারপর হঠাৎ করে একদিন ব্যাডিংপত্র নিয়ে রুস্তম মোল্লা হাজির হন আমাদের বাড়িতে । এসময় আমাদের বাড়িতে এক কান্নার রোল পড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর দিয়ে এতো ঝড়ঝাপটা বয়ে গেলেও রুস্তম মোল্লা আমার ব্যাডিংপত্র ফেলে আসেননি ।

ঐ বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ভারতের হাকিমপুর ভাদিয়ালি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৮নং সেক্টরের অধীনে যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় তারা যুদ্ধু করেছেন । যুদ্ধকালীন সময়ে রুস্তম মোল্লার সাহস ও বিভিন্ন রকম কৌশলে প্রায় প্রতিটি সংঘর্ষে পাক বাহিনীকে পরাজিত করতে সহজ হয়েছি।

তাই রুস্তম মোল্লার প্রতি কমান্ডারসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের বেস আস্থা ছিল।

বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লার পরিবার সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে কেন বঞ্চিত এমন প্রশ্ন করা হলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন চৌকিদার বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে যেসব প্রমাণাদি প্রয়োজন হয় তার সবকিছুই রুস্তম মোল্লার আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ১৯৮০ সালের দিকে বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লা নিজ বাড়িতে সর্বহারা বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে খুন হন।

মৃত রুস্তম মোল্লার ৪/৫ বছরের এক মাত্র ছেলে ইলিয়াছ মোল্লাকে নিয়ে তার স্ত্রী এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যান। এরপর থেকে তারা এলাকায় কারো সাথে তেমন যোগাযোগ করতেন না। মাঝে মধ্যে রুস্তম মোল্লার মা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আসা বিভিন্ন অনুদানের একটি অংশ আমরা তার হাতে দিতাম। কিন্তু তিনিও প্রায় ১৪/১৫ বছর আগে মারা যান ।

এদিকে ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম শুরু করলে তখন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বীর- মুক্তিযোদ্ধা মৃত রুস্তম মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আবেদন করা হয়নি । তাই রুস্তম মোল্লার বিষয়টি একটু জটিল হয়ে পড়ে । বর্তমানে মৃত রুস্তম মোল্লার ছেলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম মোল্লার বিষয়টি সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহাজান খান এম পিকে অবগত করা হয়েছে।