নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার এক ভূমিহীন পরিবারের মেয়ের নামে ৪ শতক জমি কিনে দিয়েছেন সাভার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন খান । সেই পরিবারের যে মেয়ের নামে জমি কিনে দিয়েছেন, সেই মেয়ে তার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন, সেই ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রথম আলোর সংবাদ পড়ে সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসাইন খাঁন ভাই চার শতক জমি কিনে দিলেন আমাদের।
______
আমার জীবন সম্পর্কে ডিটেইলস বন্ধুরা জানেন, তাই বক্তব্য বেশি লম্বা করবো না।
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার এক সন্তানহীন পরিবার আমাকে স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করেছেন। চিনিনা নিজ জন্মদাতাকে! বড় হয়ে যতটুকু জেনেছি আমার পালিত বাবা (যদিও তাঁরাই আমার প্রকৃত বাবা মা) কলা বিক্রি করতে গিয়ে আমাকে নাকি সান্তাহার স্টেশনে পেয়েছিলেন।
সে যাইহোক, কোন জিনিসকে কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করলে ফেলে দিবে এটাই স্বাভাবিক, আর অপ্রয়োজনীয় জিনিসটাই কেউ প্রয়োজনীয় মনে করলে কুড়িয়ে নিবে এটাও স্বাভাবিক বলে মনে করে মনকে কষ্ট পেতে দিইনা এখন আর। আগে মন খুব কষ্ট পেত, একটুতেই কান্না করত মন। খুব আবেগ ছিল মনের। এখন মনকে বোঝাই যে, মন কেউ যদি তোমাকে ভালোবাসে তাকে ওয়েলকাম দাও, আর যদি কেউ তোমাকে ঘৃণা করে তাহলেও তাকে মোস্ট ওয়েলকাম দাও।
যাইহোক যা বলতে চাইছিলাম, আমাদের আগে বদলগাছী উপজেলায় মধ্যে বাড়ি থাকলেও বর্তমানে আমরা বদলগাছী থাকিনা।
কারন পরবর্তীতে বাবার ভাইপোদের সাথে মাঝে মধ্যেই বাবা মায়ের পারিবারিক কলহলের কারনে বাবা মা রাজশাহী আমার কাছে সালেহা আপুর গ্রামে চলে আসতে চান। রাজশাহীতে আমি একটি ছোটখাটো বেসরকারী কর্ম করতাম।
বাবা মাকে নিয়ে আসার জন্য আমি জমি বিক্রি করতে গেলে বাবার ভাইপোরা আমাদের জমির কাগজ বের করে দাবি করে অনেক বছর আগেই নাকি জমি বাবা বিক্রি করেছে তাদের কাছে। অথচ এই জমি বাবা আমার নামে লিখে দিয়েছেন এবং খারিজও হয়েছে আমার নামে। আমার বাবা লেখাপড়া না জানা মানুষ। তাই বাবার দাবি, বাবা যা জমি বিক্রি করেছে তারচেয়ে বেশি কাগজে তুলেছে তারা। যাইহোক আমি আবার জমি-টমি ভালো বুঝিনা।
আর এসব ভেজাল ভালোও লাগেনা আমার। শান্তি প্রিয় মানুষ আমি। তবুও অনেক টাকা খরচ বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে এলাকার চেয়ারম্যানকে বিচার দিয়ে সারে দশ শতকের মধ্যে মাত্র দুই শতক জমির দাম চেয়ারম্যানই নির্ধারন করে ৮০ হাজার টাকা দেন। চেয়ারম্যান বলেন আমার প্রতিপক্ষের কাগজই নাকি ঠিক আছে। আমার আর এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে জমি নিয়ে এতো ঘাটাঘাটি করার ধৈর্য্য হলো না। তাছাড়া আমার আগে পিছে কেউ নাই।
বাবা মাকে রাজশাহীতে সালেহা আপুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসি।
কিন্তু রাজশাহী এসে বাধে আরেক সমস্যা। আমার বৃদ্ধ বাবা মা এলাকা ছেড়ে দূরে এসে বুঝতে পারে এলাকার টান। থাকতে পারেন না তাঁরা। এলাকার জন্য তাঁদের মন টানে। খুব জেদ করেন আবার বদলগাছী না হোক, অন্তত জয়পুরহাট আমার ফুফুর বাড়ি যেনো তাঁদের রাখি। বাধ্য হয়ে বাবা মাকে জয়পুরহাটে পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়ন এর শিরোট্টি গ্রামে আমার ফুফাতো ভাইয়ের জায়গায় কোন রকম একটি টিনের ঘর ও বারান্দা করে দিই। সেখানেই বাবা মা এখন থাকেন। ফুফাতো ভাই ভাবিরা আমার বাবা মায়ের অসুখ হলে যতটুকু সম্ভব দেখাশুনা করে। প্রতি মাসে বিকাশে বাবা মায়ের খরচ পাঠিয়ে দিই আর সময় সুযোগ মতো গিয়ে দেখে আসি আমি।
করোনাকালে হঠাৎ আমি ও সালেহা আপু দুজনেই বেকার হয়ে যাওয়ায় খুব সমস্যায় দিন যাওয়া শুরু হয় আমাদের। তবুও চাকরি থাকা অবস্থায় বাবা মাকে যত খরচ দিতাম ততোটা না পারলেও যথাসাধ্য চেষ্টা করি অন্তত প্রতিমাসে চাল ডালের খরচ দেয়ার। বেকার অবস্থায় অনেক কষ্টে সালেহা আপু এবং আমি বাবা মাকে খরচ পাঠাই। সততার সহিত যতটুকু পারি তাই করি।
এরই মধ্যে পরিচয় হয় রাজশাহী জেলার প্রথম আলোর সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ভাইয়ের সাথে। আমার দেখা অত্যন্ত মায়াময়, সৎ, ভালো মনের মানুষ আজাদ ভাই। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে প্রথম আলোতে আমাকে নিয়ে আবুল কালাম মুহম্মাদ আজাদ ভাইয়ের লেখা “রেলস্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটি বৃদ্ধ বাবা মায়ের শেষ ভরসা” শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পর বেশ সাড়া পরে। অনেক ভালো মানুষের সন্ধান পাই, পাই স্নেহ ও আশীর্বাদ।
তেমনি একজন মানুষ শাহাদাৎ হোসাইন খাঁন ভাই। আমার নিউজ পড়ে আমার সাথে তাঁর পরিচয়। আমাকে বোন বানিয়েছেন ভাই। শাহাদাৎ ভাই ঢাকা সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান)।
ভাই আমাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন। উনার স্ত্রী, সন্তান সকলের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন আমায়। ভাবিও অসাধারণ, চমৎকার ভালো মানুষ। নিউজ পড়ে শাহাদাৎ ভাই আমাদের জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা পাঠিয়েছিলেন। শুধু তাই’ই নয়, শীতে রাজশাহীর গ্রামের অসহায় মানুষের জন্য ২৫০ টি কম্বোল বিতরণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে। আমি জয়পুরহাট, পুঠিয়া, সারদাহ সেই কম্বলগুলো বিতরণ করে মানসিক শান্তি পাই। মাঝে মধ্যেই শাহাদাৎ ভাই ফোন করে আমার বাবা মায়ের খোঁজ খবর নেন।
প্রথম আলোতে আমাকে নিয়ে নিউজটি প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের বদলগাছী উপজেলার ইউএনও স্যার আমার বাবাকে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন সঙ্গে সঙ্গেই এবং তিনি আমাদের একটি সরকারী বাড়ি উপহার দেওয়ার আশ্বাস দেন এবং বিষয়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন বদলগাছীর ইউএনও স্যার।
কিন্তু আমরা তো বদলগাছী উপজেলাতে থাকিনা। আমরা থাকি বর্তমানে পাঁচবিবি উপজেলায়। বদলগাছীর ইউএনও স্যার অত্যন্ত আন্তরিক ও ভালো মানুষ। বদলগাছীর ইউএনও স্যার ফোন করে দিলেন পাঁচবিবির ইউএনও স্যারকে। আমি পাঁচবিবির ইউএনও স্যারের সাথে দেখা করলাম। পাঁচবিবির উপজেলা চেয়ারম্যান মুন্না ভাই এবং পাঁচবিবির ইউএনও স্যারও অত্যন্ত আন্তরিক ও ভালো মানুষ। সব শুনে পাঁচবিবির ইউএনও স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবা মায়ের জন্য ১০০ কেজি চাল পাঠালেন এবং পাঁচবিবি উপজেলা চেয়ারম্যান মুন্না ভাইও আমার বাবা মাকে অনেক সহযোগিতা করেন, খোঁজ খবর রাখেন।
পাঁচবিবি উপজেলার চেয়ারম্যান মু্ন্না ভাই ও ইউএনও স্যারের আমার বাবা মাকে বাড়ি করে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জমি। আমাদের নিজস্ব কোন জমি নেই। সরকারী জায়গাতে অবশ্য বাড়ি করা যায় কিন্তু সেখানেও আমারই সমস্যা। কারন সরকারী জায়গাতে বাড়ি নিতে হলে যেখানে সরকারী জায়গায় বাড়ি হবে সেখানেই গিয়ে থাকতে হবে বাবা মাকে। তখন আমার ফুফাতো ভাই ভাবিদের কাছে থাকা হবেনা। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বাবা মাকে আমার ফুফাতো ভাই ভাবিদের কাছ থেকে দূরে রাখলে তাঁদের অসুখ হলে দেখাশোনা করবে কে!?
তাছাড়া বাবা মা বা আমি কেউই পাঁচবিবির ভোটারও নই এটাও একটা সমস্যা।
তখন উপায় একটাই ফুফাতো ভাইয়ের ওখানেই কিছু জমি কিনে ভোটার আইডি কার্ড পরিবর্তন করে পাঁচবিবির আইডি কার্ড করা। কিন্তু বাবা মায়ের বদলগাছী উপজেলাতে বয়স্ক ভাতার কার্ড করা আছে। তাঁদের ভোটার আইডি কার্ড পরিবর্তন করলে বয়স্ক ভাতার সমস্যা হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমার ভোটার আইডি কার্ড বদলগাছী থেকে পরিবর্তন করে পাঁচবিবির করি।
কিন্তু সমস্যা এখন জমি কেনার। আমার ফুফাতো ভাইয়ের যে জায়গাতে বাবা মাকে ঘর করে দিয়েছি সেই জায়গাটা ৮ শতক। তারা সেই জায়গাটা বিক্রি করবে। ৫০ হাজার টাকা শতক। চার শতক জায়গা কিন্তুে পারলেও বাবা মা সরকারী বাড়িটা পাবে। কিন্তু চার শতক জমির দাম দুই লক্ষ টাকা। এত টাকা পাবো কোথায়!? ভাবলাম চাকরি বাকরি হলে টাকা জমা করে কিন্তে পারলে কিনবো না পারলে নাই। এমনটাই ভেবে অবশেষে চুপচাপ থাকি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। একদিন সকালে শাহাদাৎ ভাই ফোন দিয়ে বাবা মায়ের খোঁজ খবর নিলেন। তারপর ভাই জিজ্ঞাসা করলেন সরকারী বাড়ি পেলাম কিনা!?
আমি শাহাদাৎ ভাইকে সমস্যার কথা বললাম। ভাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন জমির দাম সহ রেজিস্ট্রি খরচ আমি দিবো। চার শতক জমি তোমার নামে কিনে ফেলো। কথাবার্তা ফাইনাল করো।
তারপর কথাবার্তা ফাইনাল করে জানালাম শাহাদাৎ ভাইকে।
পরে আমি ঢাকা একটি সাহিত্য প্রোগ্রামে গেলে শাহাদাৎ ভাই এবং ভাবি আমাকে দাওয়াত করেন উনাদের বাসায়। স্পেশালি ভাবি পিঠা খাওয়ার দাওয়াত করেন আমায় 🙂
আমি ঢাকা থেকে ফেরার পথে সাভার ভাইয়ের বাসায় যাই। ফেরার সময় ভাই, ভাবি আমার হাতে নগদ ২ লক্ষ টাকা দিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে জমির রেজিস্ট্রি খরচের জন্য আরও ১০,৫০০ টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেন। এই টাকা নিয়ে আমি জমিটা কিনে ফেলি। আজ রেজিস্ট্রি হলো। অবশেষে এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আমার নামে চার শতক জায়গা হলো।
পাঁচবিবি উপজেলার চেয়ারম্যান মনিরুল শহিদ মুন্না ভাই আমার জমিতে সরকারী বাড়ি করে দিতে চেয়েছেন।
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো শাহাদাৎ ভাই এবং উনার পরিবারের জন্য। আমি ভাইয়ের সুস্থ ভাবে দীর্ঘায়ু কামনা করি।
জীবনে অনেক সুযোগ/অফার এসেছে অর্থ সম্পদ করার। কিন্তু প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করেও অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি, নেইনি সেই সুযোগ। তাই সততার পুরস্কার হিসেবেই বিধাতা এই চমৎকার ভালো মানুষগুলোর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন আমায়।
ছোট বেলা থেকে হাজারো কষ্ট আর অবহেলা পেতে পেতে আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে হয়তো ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
কিন্তু সালেহা আপুর সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমার সেই ধারণা ফ্যাকাসে হয় এবং পরবর্তীতে আজাদ ভাই, শাহাদাৎ ভাই, টি পি অং চাচা, ফারহানা আপু, ম্যারীনা আপু, লিমা আপু, খুকু খালামনি, সাবিনা ম্যাডাম, কবি নির্মলেন্দু গুণ দাদু সহ অনেকের স্নেহ, ভালোবাসার পরশে আমার সেই ধারনা আরও ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
আগে বাঁচতে ইচ্ছে করতো না। হতাশা থেকে জীবনে দুইবার আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখ মনে করে, তারা কি খাবে, কে দেখবে তাদের! সেই চিন্তা করে ফিরে এসেছি।
কিন্তু সত্যিই বলছি এখন আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে খুব (যদিও অনেক সময় মরতে চাইলেই বাঁচতে হয়, বাঁচতে চাইলেই হয় মরণ)
তবুও ইদানিং খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে অনেক বছর। সকলে দোয়া করবেন যে কয়দিন বাঁচি যেনো সুস্থ সুন্দর ভাবে বাঁচি এবং মানব কল্যাণে যেনো লাগতে পারি।
সালেহা আপু, সুমি আপা, আজাদ ভাই, শাহাদাৎ ভাই, ফারহানা আপু, ম্যারীনা আপু, লিমা আপু, কবি নির্মলেন্দু গুণ দাদু সহ অনেক অনেক ভালো মানুষ আছেন বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।